চন্দ্রগুপ্ত নাটকের নামকরণ
নাটক-উপন্যাসের নামকরণে দু'টো রীতির
ব্যবহার হয়ে থাকে। কারও নামকরণ হয় চরিত্র-কেন্দ্রিক, কারও কারও ঘটনা-কেন্দ্রিক। সুতরাং
মগধ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা নিয়েও নামকরণ হতে পারত। দ্বিজেন্দ্রলাল চরিত্র-কেন্দ্রিক
নামকরণ করেছেন।
চরিত্র-কেন্দ্রিক নামকরণ করতে হলে নায়ক বা
নায়িকা চরিত্রকেই বেছে নিতে হয়। দ্বিজেন্দ্রলাল সেই ধ্যান-ধারণা নিয়েই নাটকের নাম
দিয়েছেন ‘চন্দ্রগুপ্ত'। চন্দ্রগুপ্তকেই তিনি নায়ক বলে মনে করেন। সেই নায়কচরিত্র
অবলম্বনেই তাই নামকরণ।
নাটকে নায়িকা কে তা নিয়ে বিরোধ দেখা দিতে
পারে। ছায়া এবং হেলেন দু'জনেই চন্দ্রগুপ্তের প্রতি আকৃষ্ট। ছায়ার সুযোগ ছিল অনেক
বেশী; তাই তার আকর্ষণের পরিচয় 'পাওয়া গেছে অনেকবার। হেলেনের সে সুযোগ ছিল না। থাকার
কথাও নয়। কিন্তু নদীর ধারে দেখা যুবরাজ চন্দ্রগুপ্তকে সে ভুলতে পারেনি। এই Love
at first sight-ই তাকে নায়িকা হয়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছিল। তাছাড়া সেলুকাসের যুদ্ধে
পরাজয়ের ফলে যে চুক্তি হয়েছিল তাতে ভারত-সম্রাজ্ঞী হয়ে হেলেনই নায়িকা হয়ে উঠতে
পেরেছিল। হেলেন ভারত সম্রাজ্ঞী হয়েছিল কি কেবল চুক্তির জোরেই? যুক্তির জোরও তার কম
ছিল না। পিতাকে সে বোঝাতে পেরেছিল যে, ধর্মের পার্থক্য মানব-হৃদয়কে পৃথক করে দেয়
না। হিন্দুরা বর্বর জাতি নয়—সংস্কৃত ভাষায় অসংখ্য মণিমুক্তা ছড়ান আছে। চন্দ্রগুপ্তের
প্রতি অন্তরের লুক্কায়িত প্রেমই তাকে উদ্বুদ্ধ করেছিল। সুতরাং তাকে নায়িকার অধিকার
থেকে বঞ্চিত করা চলে না। নাটকের একেবারে শেষে ছায়াকে সে টেনে নিয়েছিল—দুই নদী এক
সাগরে মিলবে না কেন ? তাই নাটকের নাম 'হেলেন'ও হতে পারত। কিন্তু ছায়া তাতে ছায়াই
হয়ে যেত। তারও নায়িকা হয়ে ওঠা সম্ভব ছিল। দুই নায়িকা নাট্যকারের দৃষ্টি নায়কের
দিকেই ফিরিয়েছে—তাই নাটকের নাম ‘চন্দ্রগুপ্ত'।
চন্দ্রগুপ্ত বীর, উদার এবং মাঝে মাঝে উত্তেজিত
হলেও অধীর নন। তিনি সম্রাট এবং দুই নায়িকারই স্বামী। সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই নায়ক-কেন্দ্রিক
নামকরণের দিকেই নাট্যকারের দৃষ্টি পড়েছিল।
কিন্তু চন্দ্রগুপ্ত সম্রাট হলেও কোন ব্যক্তিত্ব
তাঁকে সম্রাট করেছিল ? তিনি কি চাণক্য নন? মহারাজ নন্দের আচরণ ক্ষিপ্ত করেছিল কাত্যায়নকে,
ক্ষিপ্ত করেছিল চাণক্যকে। এই চাণক্যের কূট কৌশলেই যুদ্ধে পলাতক হলেও শেষ পর্যন্ত জয়ী
হল চন্দ্রগুপ্ত। চন্দ্রগুপ্তের স্নেহ-প্রবণ মনের দুর্বলতা চাণক্য বুঝে নিয়েছিলেন।
তাই সেই স্নেহ-প্রবণতার বিরুদ্ধে তিনি দাঁড় করিয়েছিলেন চন্দ্রগুপ্ত-জননী মুরাকে।
মাঝে মাঝে মুরাকেও উত্তেজিত করেছিলেন তিনি। নন্দ বেঁচে থাকলে তার প্রতি চন্দ্রগুপ্তের
দুর্বলতা যাবে না এটা চাণক্য বুঝেছিলেন। তাই রাজ-আজ্ঞা লঙ্ঘন করে ও মুরাকে সামনে রেখে
তিনি নন্দকে বধ করিয়েছিলেন। এর ফলেই মগধের সিংহাসনে চন্দ্রগুপ্তের আসন স্থায়ী হয়েছিল।
দক্ষিণ দেশ জয় করে দেশে ফিরলেন চন্দ্রগুপ্ত—আদেশ পাঠালেন নগরী
আলোক মালায় সাজাতে, উৎসব মুখর করে তুলতে। চাণক্য সব নিষেধ করে দিলেন। না করলে চন্দ্রগুপ্ত
বেঁচে থাকতেন কিনা সন্দেহ। তাই কেবল মগধের সিংহাসনে বসানই নয়, চন্দ্রগুপ্তকে দাক্ষিণাত্য
জয়ী সম্রাট হয়ে উঠতেও সাহায্য করেছেন চাণক্য। গ্রীক সম্রাট সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধে
জয়ী করেছেন তিনিই। চন্দ্রগুপ্তকে কর্মে প্রেরণা দিয়েছেন চাণক্য—পরিচালনা করেছেন চাণক্য।
চাণক্যের সাহায্য না পেলে চন্দ্রগুপ্ত হয় চির কারারুদ্ধ হয়ে থাকতেন, নয় তো রাজদণ্ড
নিয়ে প্রাণ দিতে হত। সুতরাং চাণক্য চরিত্র নাটকে বিশিষ্টতা পেয়েছে। নাটকের নাম তাই
‘চাণক্য’ও হতে পারত। এ নাটকের
কেন্দ্রীয় প্রধান চরিত্র হিসেবে এটাই হত যুক্তিযুক্ত।
কিন্তু নাট্যকারের দৃষ্টি পড়েছিল আরও একটা দিকে। তিনি হৃদয়বান চরিত্রকেই লক্ষ্যবস্তু করতে চেয়েছিলেন। চাণক্য নিজে কাত্যায়নকে মন্ত্রিত্ব দিয়েছেন এই বলে যে তিনি হৃদয়হীন। কাত্যায়ন মূর্খ, কিন্তু হৃদয়বান। হৃদয়হীন কূটবুদ্ধিসম্পন্ন চাণক্যকে তিনি প্রাধান্য দিতে চাননি। চাণক্যের প্রয়োজন ছিল সাম্রাজ্য পত্তন পর্যন্ত। এবার সাম্রাজ্য রক্ষা এবং প্রজা পালন। হৃদয়বান মানুষই চাই একাজে। যিনি দুই নদীকে একত্র রাখতে পারেন তিনি সমাজকে সুন্দর করতে পারবেন। একথা স্মরণ করেই তিনি নাটকের নাম দিয়েছেন চন্দ্রগুপ্ত। নামকরণ সার্থক হয়েছে।
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আরো নোট পেতে সাহিত্য বাংলা WhatsApp Group-এ যুক্ত হন


